
কৌশিক বসু , দুর্গাপুর : একটা সময়ে করমন্ডল কিংবা ম্যাড্রাস মেল (তৎকালীন নাম) মানেই ‘রূগী এক্সপ্রেস’। দাক্ষিনাত্যের তাবড় তাবড় হাসপাতালে প্রতিদিন পৌঁছাচ্ছে কাতারে কাতারে মানুষ। কারোর হৃদয়ে ফাটল, কারোর যকৃত শুকিয়ে এসেছে , কারোর বা শরীরে থাবা বসিয়েছে কর্কট, কারোর আবার গোটা যন্ত্রই বিকল হয়ে যেতে বসেছে ,আর সঙ্গে ঘরপোড়া বাড়ীর লোক ঘটি-বাটি বেচে দক্ষিনে যাচ্ছে একবুক আশা নিয়ে। দিন বদলানোর সাথে সাথে পরিস্থিতির বদল হয়ে এই ট্রেনগুলিতে ভীড় জমাল নতুন প্রজন্ম। একটু ভাল শিক্ষা , একটু ভাল উন্নতি , একটু ভাল চাকরি , একটু ভাল বেঁচে থাকার আশায়। টেকনোলজি থেকে ম্যানেজমেন্ট , দফায় দফায় এ রাজ্য থেকে পতঙ্গের মতন ছুটে গেল দাক্ষিনাত্যের সিলিকন ভ্যালি থেকে আইটি হাবে, যা এখনও ক্রম বর্ধমান। এরপর এল আর এক দল লোক ,যারা গায়ে গতরে বেশ মজবুত। গত কয়েক বছরে তারা দখল করল কামরা। অবশ্য তারা এসি , স্লিপার নয় , স্রেফ সেঁধিয়ে গেল সাধারন কামরায়। বেশ একটা কেতাবী নামকরনও হল , পরিযায়ী শ্রমিক। হালফিলে দাক্ষিনাত্যের বেশীরভাগ ট্রেনেই এদের ভীড় উপচে পড়ছে। এদের কপালে ফ্লাইট , এসি , এসব জোটেনা। এরা গাদাগাদি করে সাধারন কামরায় ! ঘর থেকে আনা ছাতাধরা বোতলে স্টেশনের কলে জল ভরে খায় আর ঘরের ‘প্রিয়া’ র সযত্নে প্লাস্টিকে বেঁধে দেওয়া মুড়ি-গুড় খেয়েই চালিয়ে নেয়।
এরা সবাই বাঙ্গালী , কেউ চায় সুস্থ হতে , কেউ চায় প্রতিষ্ঠিত হতে আবার কেউ চায় প্রত্যন্ত প্রান্তরে নিজের ঘরে যদি একটু ভাল ছাউনি বোনা যায়। এভাবেই দিনের পর দিন , রাতের পর রাত বাঙ্গালী ছুটে চলেছে দাক্ষিনাত্যে , মাধ্যম দেশের লাইফ লাইন ভারতীয় রেল।
মজার ব্যাপার হল এরা সবাই যাচ্ছে আশাকে বাঁচিয়ে রাখতে। যদিও শেষ অব্দি বাঁচাতে পারছে কিনা তা ‘ভগা’ই জানে! তবুও যাওয়া চাই , রোজ যাওয়া চাই। শিক্ষা,স্বাস্থ্য,চাকরী(সবকটির আগে সু যোগ হবে ) নামক এক অমোঘ আকর্ষনে জীবন গোছাতে ছুটছে সবাই। এ বঙ্গে এই তিনটেতে শুধুই প্রচারের ঢক্কানিনাদ ! তাই দক্ষিনে চল , এগিয়ে চল , নাহলে পিছিয়ে পড় শ্লোগান তুলেছে বাঙ্গালি।

আর সেই শ্লোগান থমকে গেল গত শুক্রবার সন্ধ্যায় উড়িষ্যার এক অখ্যাত বাহানাগা স্টেশনের কাছে। দুমড়ে মুচড়ে দলা পাকিয়ে গেল কত আশা , কত আকাঙ্খা। আধার কার্ডের পরিচয় ছেড়ে টিকিট নম্বর জুটল শয়ে শয়ে চাদর বাঁধা দেহগুলোর। যারা বেঁচে রইল , তাদের আশা বাঁচল কি না , তা হয়ত সময় বলবে। ওখানে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা , স্কুল বাড়ীতে লাইন দিয়ে শোয়ানো দলা পাকানো আশা-আকাঙ্খা। নাহ , ওখানে কোন স্লিপার ক্লাস আর সাধারন কামরার ভেদাভেদ নেই। দশ লাখ বরাদ্দ সবার জন্য ! কি অদ্ভুত সাম্যবাদের চিত্র ! অথচ মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেও হাসিমুখে রেলের পা-দানিতে চড়ে হাত নেড়েছিল তারা , ফিরব , জয় করেই ফিরব , প্রত্যয় ছিল চোখে মুখে। সুস্থ ভাবে বেঁচে ফিরব , প্রতিষ্ঠিত হয়ে ফিরব , গ্রামের বাড়িতে পাকা ছাউনি আর বাথরুমে টাইলস বসাব ভাবতে ভাবতেই মাত্র ২৩ টা সেকেন্ড ওলটপালট করে দিল গোটা জীবনটা। বাঙ্গালীর অগস্ত্য যাত্রা থমকাল উড়িষ্যার অখ্যাত গ্রামে। তারপর থেকেই ঘরের ‘প্রিয়া’ একা সজ্জায় বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে এই বাংলার আনাচে কানাচে।
তবে শুধু থমকাল , বন্ধ হল না ! ধ্বংসস্তুপ সরিয়ে জীবন স্বাভাবিক করার যুদ্ধ শুরু হয়েছে বাহানাহায়। ফের দিন কয়েকের মধ্যেই কু-ঝিক ঝিকের চাকা গড়াবে। ফের বাঙ্গালী সেঁধিয়ে যাবে স্লিপারে বা সাধারন কামরায়। জীবন যুদ্ধে লড়ে নেবে ফের একবার। তবে ওই বাহানাহা-র পাশ দিয়ে যেতে যেতে একবার ঝাপসা হবেই দৃষ্টি ! কারন এখানেই তো থমকেছিল ওই হতভাগ্যদের অগস্ত্যযাত্রা!