
কৌশিক বসু , দুর্গাপুর : ফেসবুক খুললেই একটা ছবি দেখা যাচ্ছে , এক স্কুলের বারান্দায় সারি সারি দেহ কাপড়ে ঢাকা , আর এক বাবা হাতড়ে হাতড়ে মৃতদেহের স্তুপে ছেলেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! এ দৃশ্য যে কোন স্বাভাবিক মানুষের হৃদস্পন্দন দ্বিগুন করে দেবে। উড়িষ্যার বালেশ্বরে ঘটে যাওয়া এযাবৎ কালের সবচেয়ে মর্মান্তিক রেল দুর্ঘটনায় শিউরে উঠেছে আসমুদ্র হিমাচল। প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সরকারী হিসেবে ২৯৫ জনের মৃত্যু ও হাজারের ওপর আহত। ইতিহাস বলছে এ বঙ্গের এযাবৎ কালের সর্ব্ববৃহৎ রেল দুর্ঘটনা। বাঙ্গালী গাইসাল দেখেছে , সাঁইথিয়া দেখেছে , জ্ঞানেশ্বরী দেখেছে। কিন্তু সেটা দেখেছে মেন স্ট্রিম মিডিয়ার ক্যামেরার লেন্সে। যেটার একটা সীমা ছিল। আর শুক্রবারের বালেশ্বরের ভয়াবহ দুর্ঘটনা মানুষ প্রত্যক্ষ করল স্যোশাল মিডিয়ার ক্যামেরায়। মানুষের হাতে হাতে মোবাইল হওয়ার ফলে ঘটনাস্থলের ছবি নিমেষে ভাইরাল হতে থাকল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা। আর সেই ছবি বাচ্চা থেকে বুড়ো গোগ্রাসে গিলল !

এর পাশাপাশি মেন স্ট্রিম মিডিয়াও উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে যে ভাবে কভারেজ দিচ্ছে , সেটা গাইসাল বা জ্ঞানেশ্বরীর সময়ে হয়নি।ফলে সাধারন মানুষের কাছে দুর্ঘটনার এত খুঁটি-নাটি এত বিশদে পৌঁছাত না। আর মুঠোফোনের দৌলতে মানুষের হাতের নাগালে ভয়াবহ দুর্ঘটনার কোলাজ ক্ষনে ক্ষনে প্রত্যক্ষ করল। ঠিক এই জায়গাতেই মননে পড়েছে প্রভাব। আতংকিত রেলযাত্রীরা !
দুর্গাপুর স্টেশনে এমনই ছবি ধরা পড়ল আমাদের ক্যামেরায়। দেওঘর যাওয়ার পথে অভিষেকের শরীরি ভাষায় ছিল আতংক , কারন ট্রেনে এতটা পথ পাড়ি দিতে হবে। দুর্গাপুরের বাসিন্দা নিমাই চন্দ্র ঘোষ ব্যক্তিগত কাজে আসানসোল যাচ্ছিলেন , জানালেন ঘটনার ভয়াবহতায় এতটাই আতংকিত যে এখনও ট্রেনের টিকিটি কাটা হয়নি , বাড়ী থেকে ৩ বার ফোন চলে এসেছে। কলকাতার বাসিন্দা নুরুল সালাম রবিবার পরিবার নিয়ে দীঘা যাবেন , ভেবেছিলেন ট্রেনে যাবেন , কিন্তু এখন মত পরিবর্তন করে বাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বর্ধমানের বাসিন্দা ডা: পি কে মোদক তো বলেই ফেললেন যে রেলযাত্রায় এতটাই আতংকিত , বাড়ী থেকে বেরিয়ে ফিরব কিনা জানি না। নাহ , গাইসাল বা জ্ঞানেশ্বরী দুর্ঘটনার সময়ে সাধারন মানুষকে এতটা আতংকিত হতে দেখা যায় নি।
তবে ব্যতিক্রমও আছে , যেমন দুর্গাপুরের পিন্টু জানালেন যে আতঙ্কিত নই , কারন দেশের লাইফলাইন রেল, একটা দুর্ঘটনা হয়েছে , তার প্রকৃত তদন্ত হোক। মনোজ গোপের ও একই অভিমত , একটা দুর্ঘটনা হয়েছে বলে ট্রেনে চড়া বন্ধ করব কেন ? বরং রেল উপযুক্ত তদন্ত করুক এবং কেউ দোষী প্রমানিত হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।
তবে সবার প্রশ্ন একটাই , এত আধুনিক প্রযুক্তি যেখানে ব্যবহার হচ্ছে রেলের তরফে , সেখানে এই দুর্ঘটনা ঘটবে কেন ? লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা আধুনিকিকরনে বরাদ্দ হচ্ছে রেল বাজেটে, তাও কেন লাশের স্তুপে ছেলেকে খুঁজতে হচ্ছে হতভাগ্য বাবাকে ? এই প্রশ্ন নিশ্চিত ভাবে তাদের পরিবারের ও , যারা সারি সারি ভাবে রেলেরই সাদা চাদর আর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছেন। যারা আর কোনদিনই ফিরবেন না তাদের প্রিয়জনের কাছে। দেশের লাইফ লাইনে টিকিট কেটে নিশ্চিন্তের সফর হয়ে দাঁড়াল এক দু:সহ অভিজ্ঞতা , আর স্যোশাল মিডিয়ায় প্রতিমুহুর্তে ব্রেকিং ফুটে উঠল ভয়াবহ দৃশ্যাবলীর। করমন্ডল দুর্ঘটনা নি:সন্দেহে ভারতবর্ষের বিপর্যয় মানচিত্রে আরও একটা “ব্ল্যাক ফ্রাইডে” যোগ করল যার ছাপ পড়ল মানুষের মননেও ।